• আইন আদালত

    রেললাইন টার্গেট করে হামলা

      নিজস্ব প্রতিনিধিঃ ১৪ নভেম্বর ২০২৩ , ৮:৫৭:১৬ প্রিন্ট সংস্করণ

    বিএনপির সর্বাত্মক হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির মধ্যে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটছে যাত্রীবাহী বাস, মালবাহী ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহনে। তবে এবার হামলা করা হচ্ছে রেল লাইনেও।

    এদিকে এবার রেল লাইনে আক্রমনের তথ্যও রয়েছে গোয়েন্দাদের হাতে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রেল লাইন ও ট্রেনে হামলা চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে বিশেষ দুটি রাজনৈতিক দলের কর্মীদের। দল দুটির নামও রয়েছে প্রতিবেদনে। তারা চোরাগোপ্তা হামলা চালাতে পারে রেল, যাত্রী ও রেললাইনে।

    এদিকে এই গোয়েন্দা প্রতিবেদন ও মাঠ পর্যায় থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে রেল ও রেললাইনের নিরাপত্তা সাজানো হয়েছে অবরোধ কেন্দ্র করে। রেলপুলিশের পাশাপাশি রেললাইনে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে আনসার সদস্যরাও।

    এমন নিরাপত্তার মধ্যেই রবিবার রাত থেকে সোমবার পর্যন্ত গাজীপুর, কুষ্টিয়া, দোহাজারিসহ কয়েকটি স্থানে রেললাইনে হামলার খবর পাওয়া গেছে।

    রেল লাইনের ওপর আগুন ধরিয়ে দেওয়া, স্লিপার ভাঙার চেষ্টাসহ কয়েকদিনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত করার ঘটনা সম্পর্কে বিএনপির দিকে আঙুল তুলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, দুস্কৃতিকারীরা রেললাইনকে অচল করে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার অপচেষ্টা করছে।

    যদিও এসব নাশকতার কথা বরাবরই অস্বীকার করছে বিএনপিসহ অবরোধ আহ্বানকারী রাজনৈতিক দলগুলো।

    অবরোধ ও রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘিরে রেললাইন পাহারায় থাকা আনসার ভিডিপি, রেল পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, কড়া নিরাপত্তার কারণে সরাসরি হামলা চালাতে ব্যর্থ হয়ে দুস্কৃতিকারীরা এখন চোরাগোপ্তা হামলা করছে। ধাওয়া করে কয়েকজনকে আটকও করেছেন নিরাপত্তারক্ষীরা।

    বিভিন্ন সূত্রে ঢাকা টাইমস জানতে পেরেছে, সোমবার ভোরে গাজীপুরের শ্রীপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেললাইনের গোলাঘাট এলাকার মাটিকাটা নদীর ওপর নির্মিত রেলব্রিজে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ব্রিজের পাঁচটি স্লিপার পুড়ে গেছে। এতে করে ট্রেন চলাচল ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। ঝুঁকি এড়াতে পুড়ে যাওয়া স্লিপার দ্রুত সময়ের মধ্যে সরিয়ে নতুন স্লিপার লাগিয়েছে সংশ্লিষ্ট রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। কাওরাইদ রেলওয়ের স্টেশন এলাকায় দায়িত্বে থাকা মিস্ত্রি মো. সোহেল মিয়া বলেন, আমাদের রেলওয়ের কয়েকজন কর্মচারী নিয়মিত রেললাইন পাহারা দিচ্ছিলেন। ভোরে ব্রিজে আগুন দেখতে পেয়ে আশপাশের লোকজন নিয়ে আগুন নেভানো হয়েছে। আগুনে রেলব্রিজের পাঁচটি স্লিপার পুড়ে গেছে। স্লিপার পুড়ে যাওয়ার ফলে ট্রেন চলাচলে ঝুঁকি থাকায় দ্রুত সময়ের মধ্যে পুড়ে যাওয়া স্লিপার খুলে নতুন স্লিপার লাগানো হয়েছে। জয়দেবপুর রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. শহিদুল্লাহ জানান, রেলসেতুতে দুর্বৃত্তরা ভোরে আগুন দিয়েছিল। স্থানীয়রা আগুন নিভিয়ে ফেলেন। শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ এফ এম নাসিম জানান, ভোররাতে দুর্বৃত্তরা রেলসেতুতে আগুন দিয়েছিল। স্থানীয়রা আগুন নেভান। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

    এর আগে রবিবার দিনগত রাত পৌনে ১২টার দিকে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার দোহাজারি উত্তর কালিয়াশ পয়েন্টে রেল লাইনের স্লিপার উঠানোর চেষ্টা করে ৫-৬ জনের একটি দল। এসময় সেখানে ডিউটিরত ৩ জন ভিডিপি সদস্য ডিউটিরত অবস্থায় বিষয়টি দেখতে পান। তখন ভিডিপি সদস্যরা ধাওয়া দিলে দুষ্কৃতিকারীরা দৌড়ে পারিয়ে যান। সেরাতে ডিউটিরত প্রত্যক্ষদর্শী ভিডিপি সদস্য মো. ইউসুফ বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, বিষয়টি টের পেয়ে আমার ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে থানা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সকলকে অবগত করেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার বা আটক করা সম্ভব হয়নি।

    একই রাতে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার বালিয়াশিশা-মাঠপাড়া নামক স্থানে কয়েকজন দুষ্কৃতকারী রেল লাইনের কাঠের স্লাবে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগান। পরে সেখানে দায়িত্বরত আনসার সদস্যরা আগুন দেখে তাদের তাড়া করেন এবং আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন।

    গত ১০ নভেম্বর দুপুর ১২টার দিকে রাজশাহীতে রেলওয়ের মেইন লাইনে আগুন দিয়ে নাশকতার চেষ্টা চালায় দুর্বৃত্তরা। ট্রেন চালক (এসএলএম) আমিনুল ইসলাম জানান, ‘১০ নভেম্বর দুপুর ১২টার দিকে ওয়াস ফিডের বাইরে ট্রেন শান্টিং দিচ্ছিলাম। এসময় পাশের মেইন লাইনের জয়েন্ট স্লিপারের আগুন দেখতে পায়। পরে ইঞ্জিন থেকে নেমে পানি দিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলেন। তারপরও রাজশাহী হতে বিভিন্ন রুটে ট্রেন চলাচলকারী এই মেইন লাইনে জয়েন্ট স্লিপারের প্রায় একাংশ পুড়ে গেছে।’ সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন জিআরপি থানার সেকেন্ড অফিসার সাহাদত হোসেন, রেলওয়ে রাজশাহী অঞ্চলের আইডাব্ল ভবেশ চন্দ্র ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। জিআরপি থানার সেকেন্ড অফিসার সাহাদত হোসেন জানান, ‘এটি নাশকতা নাকি অন্য কিছু বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’

    এসব বিষয়ে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন ঢাকা টাইমসকে বলেন, বিএনপি চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে অবরোধের নামে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে চায়। তা হতে দেওয়া হবে না। আমি রেল, যাত্রী ও রেল লাইনের নিরাপত্তা আরও বাড়াতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেছি। নিরাপত্তা আরও বাড়ানো হবে।

    মন্ত্রী বলেন, রেলপুলিশ, রেল নিরাপত্তা বাহিনী ও আনসার রেল লাইন পাহাড়া দিচ্ছে। নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হবে।

    তিনি বলেন, ‘বিএনপি তো আন্দোলন করছে না সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করছে। রেল রাষ্ট্রীয় সম্পদ-তা তারা ধ্বংস করছে।’

    বিএনপিকে প্রতিহত করতে জনগনকে এগিয়ে আসার আহ্বানও জানান মন্ত্রী।

    এর আগে গত ৬ নভেম্বর ভোরে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথের টঙ্গী-জয়দেবপুর স্টেশনের সামান্তপুর এলাকায় রেললাইনে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করে জামায়াত ইসলামের কর্মীরা। জয়দেবপুর জংশনের স্টেশন মাস্টার মো. হানিফ আলী ও জয়দেবপুর রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ শহিদুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘দুষ্কৃতিকারীরা জয়দেবপুর-টঙ্গী স্টেশনের মাঝামাঝি ধীরাশ্রম এলাকায় রেললাইনের ওপর টায়ার জ্বালিয়ে আগুন দেয়। এ সময় তারা রেললাইন অবরোধের চেষ্টা করে। খবর পেয়ে রেলওয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে দুষ্কৃতিকারীরা চম্পট দেয়।’

    এদিকে গত ১ নভেম্বর বিকালে ঢাকা-রাজশাহী রেল রুটের গাজীপুরের কালিয়াকৈরে পাঁচলক্ষ্মী এলাকার রেললাইনে আগুন দেয়া হয়। এ সময় এলাকাবাসী টের পেয়ে এগিয়ে গেলে দুর্বৃত্তরা গজারি বনে পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয়রা পানি দিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলে।

    রেল লাইনে আগুন দেয়ার বিষয়গুলো নিশ্চিত করে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর উপ-পরিচালক (প্রকল্প-প্রশিক্ষণ) ও গণসংযোগ কর্মকর্তা মো. জাহিদুল ইসলাম বলেছেন, ‘রেল, সড়ক ও নৌ পথে যোগাযোগ নির্বিঘ্ন রাখতে ‘অপারেশন সুরক্ষিত যাতায়াত’ এর লক্ষ্যে সারা দেশে সর্বমোট ৬৫ হাজার আনসার ও ভিডিপি সদস্য মোতায়েন আছে। রেল লাইন রক্ষায় সারা দেশে ১ হাজার ৪৭৬টি পয়েন্টে ১০ হাজার আনসার-ভিডিপি সদস্য মোতায়েন করা আছে। এছাড়া রাজনৈতিক বিভিন্ন দলের ডাকা অবরোধে রেল স্টেশন, বাস স্ট্যান্ড, লঞ্চ ঘাট, সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এবং জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানে তারা মোতায়েন থেকে তারা নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালন করছেন।’

    এ বিষয়ে রেলপুলিশের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মো. দিদার আহম্মদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, রেলের যে ব্যবস্থাপনা আছে তা চলছে। নাশকতাকারীদের হাত থেকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ রেল ও রেল লাইন রক্ষায় আমরা তৎপর রয়েছি। আমরা আগাম তথ্য পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। দুস্কৃতিকারীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, মামলা দেওয়া হচ্ছে।

    এই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, নাশকতা বা এ ধরনের কোনো খবর পেলে আমরা তাৎক্ষণিক সেখানে যাই। রেল পুলিশের অধীনে ৬টি জেলায় ৬জন পুলিশ সুপার রয়েছেন- যারা সরাসরি নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করে থাকেন। জনবল কম থাকায় স্থানীয় থানা ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। জনসমাবেশ করা হয় সচেতনতার জন্য- যেন মানুষ দেশের সম্পদ রক্ষায় সচেষ্ট হয়। আমরা সমাবেশ করে মানুষ বোঝানোর চেষ্টা করি যে, রেল জনগনকে সেবা দিয়ে থাকে- এটা যারা ক্ষতিগ্রস্ত করতে চায় তাদের ধরিয়ে দিন, তাদের বয়কট করুন, খারাপ মানুষের পরিনাম ভালো হয় না।

    রেল ও রেল লাইনের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে বলেও জানান এই অতিরিক্ত আইজিপি।

    আরও খবর

    Sponsered content