• বিশেষ প্রতিবেদন

    বিএনপি নেতৃত্ব নিয়ে ‘চিন্তিত নয়’, শত প্রতিকূলতার মধ্যেও ‘অব্যাহত থাকবে’ কর্মসূচি

      নিজস্ব প্রতিবেদক।। ৩ নভেম্বর ২০২৩ , ৫:৩৮:৫৫ প্রিন্ট সংস্করণ

    সরকার পতনের এক দফা দাবিতে চূড়ান্ত আন্দোলনের মহাযাত্রায় ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশে পুলিশের হামলার অভিযোগে ২৯ অক্টোবর সারাদেশে হরতাল এবং মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার টানা ৭২ ঘণ্টা অবরোধ কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। এতে বিভিন্ন সহিংস ঘটনায় মামলা হয় ৮৬টি। আটক করা হয় দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে। সরকার পতনের এক দফা দাবিতে তফসিল ঘোষণা পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকার পরিকল্পনা ছিল বিএনপির। কিন্তু ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশে হামলার প্রতিবাদে হার্ডলাইনে দলটি।

    দলের শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে বিএনপি নেতারা বলেন, সরকার ১৫ বছর ধরেই অত্যাচার করে আসছে। জেলখানা আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। বিএনপি যখন চূড়ান্ত আন্দোলনে নেমেছে, সব রোডম্যাপ ঠিক করেই নেমেছে। আমরা জানি নেতাদের গ্রেপ্তার করা হতে পারে। নেতৃত্ব নিয়ে বিএনপি চিন্তিত নয়।

    বিএনপির এক যুগ্ম মহাসচিব দৈনিক আজকের খবর কে বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া বন্দি, তারেক রহমানকে মিথ্যা মামলা দিয়ে দেশান্তরি করে রাখা হয়েছে। তারপরও আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে এসেছে। আর নেতাদের গ্রেপ্তার করে আন্দোলন স্তব্ধ করার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যাবে। বিএনপি অনেক বড় দল। এখানে এ বি সি ডি সব রেডি আছে।’

    এ বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘জনগণের আন্দোলন কখনো বৃথা যায় না। এই আন্দোলনও বৃথা যাবে না। বিএনপি একটি সমুদ্র। এ থেকে এক পদ্মার সমান পানি নিলেও সমুদ্রের কোনো ক্ষতি হবে না। তবে, সমুদ্রের তাণ্ডবও খুব ভয়ানক। আর সরকারের জন্য তাই অপেক্ষা করছে।’

    বিএনপির একাধিক নেতা বলেছেন, সরকার পরিকল্পিতভাবে শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশে হামলা করে বিএনপিকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এরপর বিএনপির গণতান্ত্রিক কর্মসূচিকে সরকার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ট্যাগ দেয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে বিএনপির প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থনের কারণে। ২৯ অক্টোবর বিএনপির হরতাল কর্মসূচিতে নেতারা সেভাবে মাঠে না থাকলেও সারাদেশের সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করেছে। এরপর ৭২ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচিও নজিরবিহীনভাবে সারাদেশেই পালিত হয়েছে। অবরোধে দূরপাল্লার কোনো বাস চলাচল করেনি। মহাসড়কগুলো ছিল একেবারে ফাঁকা। রাজধানীতে স্বল্পসংখ্যক গণপরিবহন চলাচল করলেও ব্যক্তিগত গাড়ি বের করেননি অনেকে। নৌপথেও লঞ্চ চলাচল করেনি। ট্রেন চলাচল করলেও যাত্রী ছিল কম। এতে প্রমাণিত হয়েছে বিএনপির আন্দোলনের প্রতি সাধারণ মানুষের নীরব সমর্থন রয়েছে। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, এটি আন্দোলনের এক ধরনের বিজয়। তাই চলমান আন্দোলন থেকে পিছু হটার কোনো সুযোগ নেই।

    নেতারা জানিয়েছেন, তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত টানা কর্মসূচি থাকবে। যদি তফসিল ঘোষণা হয় তাহলে আরও কঠোর কর্মসূচি আসতে পারে।

    বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে গতকাল দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের যেকেনো কৌশলে গ্রেপ্তার এড়ানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া জেলায় জেলায় আরও কঠোরভাবে কর্মসূচি পালনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করার পাশাপাশি কার্যত পুরো অচলের চিন্তা করছে দলটি। কর্মসূচি পালনকালে সাধারণ মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর জন্য কর্মীদের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষের সমর্থন থাকায় চলমান কর্মসূচি অব্যাহত রাখার পরামর্শ দিয়েছেন সিনিয়র নেতারা।

    দলীয় সূত্র জানিয়েছে, আন্দোলন কর্মসূচি সরাসরি তদারকি করছেন তারেক রহমান। ভার্চুয়ালি বিএনপির সিনির নেতাদের পাশাপাশি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছেন। কখনো মাঠের সক্রিয় কর্মীদের সঙ্গে ফোনে নানা নির্দেশনা দিচ্ছেন। এছাড়া অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের দায়িত্বশীল নেতারা মাঠের কর্মীদের সঙ্গে সমন্বয় করে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘গত দুই বছর ধরে সরকারের পতন দাবিতে গণতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন করছে বিএনপি। এতে তিনটি বিষয়ে বিএনপি সাফল্য পেয়েছে। এক নম্বর হলো এই আন্দোলনে সরকারবিরোধী সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলকে একত্র করেছে। দুই হলো বিএনপির দাবির পক্ষে গণতন্ত্রকামী সাধারণ মানুষের সমর্থন বেড়েছে। এর প্রমাণ বিএনপির প্রতিটি সমাবেশে লাখ লাখ সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ। যখনই বিএনপি সমাবেশ ডাকে মানুষের স্রোত তৈরি হয়। তিন নম্বর হলো- বিএনপির চলমান আন্দোলনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশ অব্যাহতভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া বিএনপির গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সরকার স্বাধীনতার চেতনা বিরোধী ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ট্যাগ দিতে চেয়েছিল। এর জন্য পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ব্যর্থ হয়েছে। সরকার এখন ভীত সন্ত্রস্ত। তাদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছাড়া আর কেউ নেই। চলমান কর্মসূচি অব্যাহত থাকলে রাষ্ট্রের পেশাদারী জনবল ও সাধারণ জনগণ রাজপথে নেমে এসে সরকারের অন্যায় কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাবে।’

    এদিকে, বিএনপির সিনিয়র নেতাদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রেখেছে পুলিশ। প্রতিদিনই কেন্দ্রীয় নেতাদের বাসায় অভিযান চালানো হচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাসহ সারাদেশে কয়েক শত নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। নেতাদের না পেয়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে পরিবারের সদস্য, ব্যক্তিগত সহকারী, গাড়িচালক, কেয়ারটেকারকে। বৃহস্পতিবার রাত ৩টায় রাজধানীর মোহাম্মদপুরে এক নিকটাত্মীয়ের বাসা থেকে বরিশাল সিটি করপোরেশন সাবেক মেয়র, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মজিবুর রহমান সারোয়ারকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি পুলিশ। এর আগে রাত ১টার পর গুলশানের ৮১ নম্বর রোডের একটি বাড়ি থেকে বিএনপির স্থায়ী কমিটি সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ।

    এছাড়া গতকাল ঢাকা উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক, যুবদল ঢাকা মহানগর উত্তরের সদস্য সচিব সাজ্জাদুল মিরাজ, স্বেচ্ছাসেবক দলের সহ-সভাপতি ডা. জাহিদুল কবির, সিরাজগঞ্জ জেলা ড্যাবের সদস্য সচিব ডা. আতিকুল আলম, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের ৩৩তম ব্যাচের সাবেক ছাত্র জাতীয়তাবাদী চিকিৎসক ডা. এম এ আজিজসহ শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

    ২৮ অক্টোবরের সহিংসতার পর থেকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে গ্রেপ্তার করা হয়। অপরদিকে গ্রেপ্তার এড়াতে বেশির ভাগ সিনিয়র নেতা গাঢাকা দিয়ে আছেন। কেউই নিজ বাসায় থাকেন না। শুধু কেন্দ্রীয় নেতা নন, জেলা উপজেলা পর্যায়ে বিএনপির কর্মীরা গ্রেপ্তার এড়াতে ধানক্ষেতে মশারি টানিয়ে রাত কাটাচ্ছেন। অনেকে জঙ্গলে ঝোপের মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাত্রিযাপন করছেন।

    বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গ্রেপ্তার হয়েছেন বিএনপির মিডিয়া সেলের আহবায়ক জহির উদ্দিন স্বপন। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশে জনস্রোত দেখে সরকার জনগণের ওপর রীতিমতো যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। সরকার বিএনপির গণতান্ত্রিক কর্মসূচিকে নস্যাৎ করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ সরকারের এই অপপ্রচারে কান দেয়নি। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে। যেহেতু সাধারণ মানুষ বিরোধী জোটের এই কর্মসূচিতে নীরব সমর্থন দিয়েছে তাই আগামীতেও আমাদের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।’

    বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান  বলেন, ‘বিএনপির আর পিছু ফেরার সময় নেই। গ্রেপ্তার করে, হুলিয়া দিয়ে আন্দোলন স্তব্ধ করার কোনো সুযোগ নেই। বিএনপির প্রতিটি কর্মীই নেতার ভূমিকা পালন করে এ আন্দোলনে সফলতা আনবে।’

    তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অটল রয়েছি। দাবি আদায়ে রাজপথে ছিলাম, রাজপথে আছি। জুলুম-নির্যাতন, মিথ্যা মামলা-হামলা, গ্রেপ্তার করে এদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনকে নস্যাৎ করা যাবে না।

    আরও খবর

    Sponsered content